প্রতিদান

“আমি কিন্তু তোমাকে ওদের মতো করে টানতে পারবো না” প্যারালাইসিস রোগিকে দেখিয়ে হার্ডের রোগি স্বামী নূরকে বলল কুসুম। কুসুমের কথা শুনে নূর হতবম্ভ হয়ে গেলো। কি বলে এসব কুসুম। নূরকে হার্ডের গুরুতর পরিস্থিতির কারণে হাসপাতালে আসতে হয়। নিঃস্বন্তান এই নূরের একমাত্র ভালোবাসার ধন অর্ধাঙ্গী কসুম। নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ বলি দিয়ে যে নূর কুসুমের পাশে দাড়িয়েছে সেই কুসুম আজ কতো সাবলিল ভঙ্গিমায় কথাটা বললো। এ ব্যাথা কাউকে বলার নয়। একাকি মানুষের সঙ্গ প্রাপ্তির চেয়ে বড় ধন যেমন আর কিছু নেই তেমনি সেই মানুষটির দেয়া কষ্টের মতো খারাপ অনুভূতি আর হয় না। নিম্নবৃত্ত ঘরের একরত্তি কুসুমকে ঘরে এনেছিলো বলে নূরকে অনেক কষ্ট পেয়ে হয়েছে কিন্তু কুসুমের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে থেকেছে সে। কুসুমকে বিয়ে করার কারণে বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে এসেছে।

নূর যার জন্য জীবনের সকল কিছু ত্যাগ করে চিরকুমার থাকার ব্রত ভেঙেছে; সেই কুসুম আজ স্বামীর কষ্টের সময় এমন করে কথা বলছে। হঠাৎ দৈহিক অবনতির কারণে নূরকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর খবর পেয়ে একদিন পর হাসপাতালে আসে নূরের অর্ধাঙ্গী কুসুম। হাসপাতালে এসে নূরের পাশে থাকার বদলে নূরকে কথা ছুড়ি দিয়ে কষ্ট দিয়ে চলেছে অবিরত। নূর রীতিমত বিরক্ত কিন্তু শরীরে এই পরিস্থিতিতে কি করার আছে তাঁর। সময় বাড়ছে আর কথার জ্বালা বাড়ছে। কেবিনে টিকে থাকায় দায় হয়ে উঠেছে। আর সহ্য করতে পারছে না সে। তাই অসুস্থ দেহ নিয়ে নূর স্যালাইন রাখার স্ট্যান্ডটা ধরে উঠে বসল। কুসুম সবই দেখছিলো কিন্তু অপরিচিতের মতো বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করলো না। নূর যে সমুদ্র সমান ভালোবাসা নিয়ে কুসুমের দারস্থ হয়েছিলো সে তাঁর যোগ্য ছিলো না এখনও নয়। কিন্তু এ কথা বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে নূরের। জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে যখন কাছের মানুষটা পর হয়ে যায় তখন আর কিছুই করার থাকে না। নূরের চোখের সমুদ্রে তখন বান ডাকে। প্রবল বেগে ঝরে চলে কষ্টের ঝর্ণাধারা।

নূর বেড থেকে নামলো বুকের বাম পাশটা তাঁর এখনো চিনচিন করছে। নূরের এ পরিস্থিতির জন্য শরীর নয় দায়ী আত্মিক বির্পযয়। এটি সেই বির্পযয় যা কুসুম নামের মানবী প্রিয়ার অবহেলায় সৃষ্টি। বেড থেকে নেমে অনেক চেষ্টা করেও পায়ে জুতোটা পরতে পারলো না নূর। অগত্যা খালি পায়েই কেবিন থেকে বের হলো সে। নূরের দিকে খেয়াল নেই কুসুমের, কথার ঝাল মিটিয়ে কুসুম আত্মীয়-স্বজনের আনা খাবার খেতে ব্যস্ত। নূর কেবিন থেকে বের হয়ে দিকভ্রান্ত পাগলের মতো ছুটে চলেছে। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, যন্ত্রণায় নূর আজ বির্বণ। হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে পড়লো নূর, কিন্তু নূরের ছুটে চলা থেমে নেই। ছুটে চলারই তো কথা ছিলো, সারাজীবন ছুটেই চলবে সে, কখনোই থামবে না। কারোর ডাকেই নয়। হঠাৎই নিজের অজান্তে এভাবে কুসুমের সাথে জরিয়ে পরবে সে ভাবেনি। নাহ্, আর পারছে না নূর! হাঁপিয়ে ওঠেছে সে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি নূর আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সে হাসপাতাল থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। এখানে কুসুম নেই, এ স্থান কুসুমের চেয়েও কোমল। প্রকৃতি এখানে রোমন্থনের মায়া জাল বিস্তার করে রেখেছে। আকাশের দিকে তাঁকিয়ে নূর একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ধপ করে বসে পড়লো। ভীষণ ক্লান্তিতে চোখজুড়ে ঘুম এসেছে নূরের! বসা থেকে মাটিতে শুয়ে পড়লো সে।

ক্লান্তিতে দুচোখ বন্ধ করল। চোখে ভেসে এলো সেই সেদিনে কথা। নূর তখন তাগড়া যুবক। যৌবনের উদ্দীপ্ত গতিতে নূরের সামনে দাঁড়াবার মতো যুবক তৎকালীন ছিলো না। মানুষের সেবাই সদা পরোপকারী নূর সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষের পরম বন্ধু। স্বার্থহীন ছুটে চলায় নূরের জুড়ি নেই। স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায় সমসাময়িক অভাবগ্রস্থদের দেবতা ছিলো নূর। ছাত্র জীবন হতেই সেবার ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলায় নূর বদ্ধ পরিকর। এলাকার সর্ব সাধারণের জন্য দানবীর ছিলো নূর। অকপটে সবার সাহাযার্থে এগিয়ে যেতো সে। ছোটবেলা থেকেই মহত্ব লালিত নূরের আলোতে আলোকিত হয়েছে অনেকেই। নিজের গায়ের শীতবস্ত্র দিয়ে শীতার্তের শীত নিবারণ করেছে নূর। বয়স তখন ত্রিশ ছুঁই ছুঁই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে নূর তখন ব্যবসা আর সমাজ সেবায় ব্যস্ত। সেবার নেশা তাঁকে এমনভাবে পেয়ে বসেছিলো যে জীবনে বিয়েই করবে না এমন সিদ্ধান্ত নেয় নূর। কাজের চাপ না থাকায় নূর সেদিন বাসায় বসে ঝিমুচ্ছিলো। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। রোমন্থন ভেঙে নূর দরজা খুলল। দরজা খুলেই নূর অবাক। দরজার তাঁর ছোট্টবেলার বন্ধু সরফরাজ দাঁড়িয়ে। হঠাৎ বন্ধুর দেখা পেয়ে নূর উল্লসিত হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। কি খবর বন্ধু এতোদিন পর, কোথায় ছিলে তুমি?- নূর জানতে চাইলো। উত্তরে সরফরাজ মলিন কন্ঠে তার ভালো থাকার কথা জানালো। সরফরাজ শুধূ নূরের ছোটবেলারই বন্ধুই নয় মুক্তিযুদ্ধে সহযোদ্ধাও ছিলো সে। দেশ মৃত্তিকা রক্ষার জন্য দুই বন্ধু হাতে হাত রেখে ঝাপিয়ে পরেছিলো। কতো স্মৃতি সরফরাজকে ঘিরে..। এক মুহুর্তের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলো নূর সেই সোনালি অতীতে। মুক্তিযুদ্ধের পর দশ বছর পরে এইবারই প্রথম দেখা হলো ওদের। সরফরাজের মলিন মুখ দেখে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছে না বললে জানবো কিভাবে বন্ধু?”

সরফরাজ কাঁদতে কাঁদতে নূরকে জড়িয়ে ধরে বলল “বন্ধু আমার ছোট বোনটার বিয়ে কিন্তু কিছুই আয়োজন করতে পারিনি, কিভাবে কি করবো তাও বুঝতে পারছি না!” মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগে সরফরাজদের বাড়িতে বিদায় নিতে গিয়ে দেখেছিলো কুসুমকে। কুসুম তখন অনেক ছোট। সেই ছোট্ট মেয়েটা বিয়ে দেয়ার বয়সী হয়ে গেছে ভাবতেই অবাক লাগে। সরফরাজের কথা শুনে নূর স্বহাস্যে বলল “এইটা কোন কথা, আমি কি মরে গেছি।” নূরে কথায় সরফরাজ শস্তির নিশ্বাস ফেললো। সরফরাজ অবশ্য এই আশা নিয়েই এসেছিলো নূরের কাছে যে অন্তত সে এখানে খালি হাতে ফিরবে না। নূরের কাছে অপরিচিত কেউ সাহায্য চেয়ে কোনদিন খালি হাতে ফেরেনি আর সরফরাজ তো নূরের বন্ধু। সরফরাজ এর জন্য তো নূরের জান হাজির। অনেকদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা নূর যেন আকাশ হাতে পেয়েছে। অনেক স্মৃতি চারণ হলো, হলো জানা শোনা। পাশের গ্রামের রফিকের সাথে বিয়ে হচ্ছে কুসুমের। রফিক বড়ঘরের ছেলে বাবা গ্রামের নামিদামি মানুষ। বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে আগামী শুক্রবার। হাতে আর মাত্র ৫দিন সময়। নূর গল্প শেষে সরফরাজকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো বিয়ের কাজে। নূরের ঝলকানিতে এখন সব কাজ ঝড়ের বেগে হয়ে যাচ্ছে। সকল আয়োজন শেষ, যার প্রায় বেশিরভাগ অর্থ নূরের দেয়া। আয়োজনও শেষ সময়ও শেষ আজ বিয়ে কুসুমের। বড় এসেছে, বউ সাজানো হয়েছে; সারা বাড়ি ভর্তি মানুষে গমগম করছে। বিয়ের কাজ শুরু হলো। কাজী বিয়ে পড়াতে শুরু করবেন হঠাৎ বরের বাবা বলে উঠলো “ না, এমন তো কথা ছিলো না, কথা ছিলো বিয়ে পড়ানোর আগে যৌতুকের পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে দেবে! সেটা কই? টাকা না দিলে বিয়ে বন্ধ।” কথা শুনে সরফরাজের বাবা শরিফ করজোড়ে বরের বাবার কাছে বিনতি করে বললো “বেয়াই সাহেব, বিয়ের আয়োজন করতে টাকা জোগার করতে পারিনি আপনি যদি টাকাটা পরে নিতেন তাহলে..?” কথা শুনে বরের বাবা হুকার দিয়ে উঠলো “এ বিয়ে হবে না। টাকা না দিয়ে মেয়ে আমার ছেলের গলায় ঝুলানোর ফন্দি ভালোই এঁটেছেন” কথা শেষ হতে না হতেই রফিককে হেঁচকা টান দিয়ে টেনে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যেতে লাগলো ওর বাবা। কুসুমের বাবা পায়ে রফিকের বাবার পায়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। কিন্তু নিষ্ঠুর মানুষ পা দিয়ে লাথি দিয়ে কুসুমের বাবাকে মাটিতে ফেলে দিলো। এখন কাঁদা ছাড়া আর কি করার আছে কুসুমের। সারা পরিবারের আজ শোক। এ শোক মৃত্যু শোকে আবহকেও হার মানিয়েছে। এতকিছু যখন হয়ে শেষ তখন সবে নূর বিয়ের মিষ্টি কিনে ফিরেছে। বাড়িতে শোকের মাতম দেখে নূর হতবাক। কি হলো এখানে এতো তাড়াতাড়ি তো বিয়ের আয়োজন শেষ হবার কথা নয়। কান্নারত সরফরাজের কাছে গিয়ে জানতে চাইলো নূর “ব্যাপার কি?” সরফরাজ সব খুলে বলল নূরকে। নূরের চোখে মুখে ক্ষোভ প্রস্ফুটিত। মানুষ কিভাবে এরকম হীন হতে পারে সামান্য যৌতুকের জন্য। আর এমন সময় কাজটা হয়েছে যখন নূরের কিছুই করার ছিলো না। নূর খেয়াল করলো সরফরাজের বাবা দৌড়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে দরজা আটকে দিলেন। নূর ঘটনা বোঝার আগেই সবাই হায় হায় করে উঠল। কন্যাদায় গ্রস্থ বাবার হাঁহাকার যে কতো কষ্টে সে অভিজ্ঞতাও আজ নূরের হবে সে এটা ভাবেনি।

লোকজনের চিৎকারে বুঝতে বাঁকি রইলো না সরফরাজের বাবা কি করতে গিয়েছেন ঘরে। লাফ দিয়ে উঠে পড়লো নূরে সরফরাজের তোয়াক্কা না করে দৌড়ে দিয়ে বন্ধ দরজায় লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলল। ততক্ষণে সরফরাজের বাবা ঘরের ফ্যানের সাথে দড়ি ঝুলিয়ে গলায় পড়ে নিয়েছে। নূর হাতে সরফরাজের বাবার গলা হতে দড়ি খুলে মাটিতে নামিয়ে আনলো। একে তো কন্যাদায় তার উপরে মরতে না পারার কষ্ট; দুয়ে মিলে অসহ্য কষ্টে লেলিহান আগুন। মাটিতে গড়াগড়ি দিতে শুরু করলো সরফরাজের বাবা। এতো কষ্টে আয়োজন করেও মেয়েটার বিয়ে দিতে পারলেন না তিনি। কন্যাদায় গ্রস্থ বাবা, বন্ধুর চোখের পানি, নিষ্পাপ কুসুমের চোখের পানি; সবমিলিয়ে জলন্ত এক দোজখের চেয়ে কম কষ্টের নয় পরিস্থিতিটা। নূর কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

সরফরাজের কাছে গিয়ে বসে পড়লো নূর। ভাবছে কি করা যায় কিভাবে এর সমাধান সম্ভব। ভাবতে হঠাৎই সরফরাজকে নূর বলল “বন্ধু তোমার বোনকে আমি বিয়ে করবো!” সরফরাজ আকাশ থেকে পড়লো কি বলে নূর। নূর কোথায় আর তারা কোথায়। নূর কোটিপতি বাবার শিক্ষিত ও একমাত্র সন্তান আর কুসুম অশিক্ষত সাদামাটা গ্রামীন মেয়ে। সরফরাজ বললো “কিন্তু কিভাবে সম্ভব?” নূর বলল আর কোন কিন্তু নয়…। নূরের সিদ্ধান্তের উপরে কথা বলার সাহস কারোরই নেই। বিয়ে হলো নূরের সাথে কুসুমের। নূর জানে বাড়ি থেকে কেউ তার এই বিয়েকে মেনে নেবে না। হ্যাঁ মেনে নিলোও না। শুরু হলো কষ্টের জীবন। কষ্টের জীবন বলতে মা-বাবা ছেড়ে থাকা। মা-বাবার বেঁচে থাকা অবস্থায় তাদের পাশে থাকতে না পারাটা অত্যন্ত কষ্টের। সব কষ্ট নিয়েও গেঁয়ো কুসুমকে অফুরান ভালোবাসা দিয়েছে নূর। কিন্তু আজ সেই কুসুম এমন করে কথা বলে।

মাটিতে মাথা লাগিয়ে দুচোখে পানির ঝর্ণা বইয়ে চলেছিলো নূর। হঠাৎ মায়ের ডাক “নূর কাঁদছিস ক্যানো বাবা, ব্যাথা পেয়েছিস আয় বাবা আমার বুকে আয়” চমকে উঠলো নূর! মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল নূরের মা সামনে দাড়িয়ে কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? নূরের মা তো দশবছর আগেই মারা গেছে। তাহলে নূরের মা কিভাবে নূরকে ডাকছে?

 

মো. আরমান হোসেন

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক

আলোর সন্ধানে।

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *