বিলুপ্তির পথে পুঁথি সাহিত্য
|আজ থেকে প্রায় ৩৫/৪০ বছর আগের কথা। আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। অল্প করে হলেও মাঝে মধ্যে তখনকার কিছু কথা, কিছু স্মৃতি আজ ও মনে হয়। তখন শহর বলতে কেবল বিভাগীয় শহর গুলোকেই বুঝতাম। বাঁকী সব গুলোকে গ্রাম মনে করতাম। তখন দেখতাম আমার আব্বা, চাচা, মামা, বড় ভাইদের মধ্যে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ গরুর গাড়ীতে, কেউ ঘোড়া গাড়ীতে, কেউ সাইকেলে চড়ে সিনেমা দেখতে দূরে কোথাও যেত। কারণ, গ্রামে বিনোদনের তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না। বিনোদনের মধ্যে কেবল মাত্র ফুটবল, কাবাডী, গোল্লাছুট, দারিয়াবান্ধা এ জাতীয় খেলাধুলা ছিল। গ্রামের সাধারণ মানুষ যখন সারা দিনের পরিশ্রম শেষে বাড়ি ফিরে, তখন তার সর্বাঙ্গে নেমে আসে ক্লান্তি। সামান্য সময়ের জন্য তারা বিশ্রাম নিয়ে আবারও ব্যস্ত হয়ে ওঠেন কোন বাড়ীর উঠোন বা আঙ্গিনা বড় সেখানে সমবেত হওয়ার জন্য। কেউ হ্যারিকেন, কেউ কেরোসিনের প্রদীপ, কেউ বা খরের তৈরি এক প্রকারের বুন্দি (যাতে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার ব্যবস্থা করা হত) নিয়ে উপস্থিত হত। মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ধোাঁয়া দেওয়া হত। কিন্তু কেন এত বড় উৎসব? কি হবে আজ সেই বাড়িতে? কেনই বা এত লোকের ভীড় এই বাড়িতে?
কিছুক্ষন পর আমি জানতে পারলাম আজ পুঁথি পাঠের আসর বসবে। এক সময় গ্রামের মানুষেরা এই পুঁথি পাঠ করাকেই বিনোদনের একমাত্র বড় একটি মাধ্যম মনে করত। তারা বিদ্যাশিক্ষার একটি মাধ্যম হিসেবে এই পুঁথি পাঠ করত। এই পুঁথি পাঠ সাধারনত সন্ধ্যায় যখন সকলেই পরিশ্রম শেষে বাড়ি ফিরে তখনই অনুষ্ঠিত হয়।
১৭৬০-১৮৬০ খ্রি: পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে বাংলা, হিন্দি, আরবী, ফার্সী ভাষা মিশ্রিত এক ধরনের সাহিত্য যা ছন্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হত তাই পুঁথি সাহিত্য নামে পরিচিত। যেমন- সত্য পীরের পুঁথি, সোনাভানের পুঁথি ইত্যাদি। আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে- এক সময় গ্রামের মানুষেরা ছন্দের তালে তালে তখনকার লোককাহিনী, কল্পকাহিনী সম্পর্কে যা বোঝাতেন বা ফুটিয়ে তুলতেন তাকে পুঁথি সাহিত্য বলা হয়।
বর্তমান বা এই বিংশ শতাব্দীর তরুণ প্রজন্মরা এই পুঁথি সাহিত্য কি তা সঠিক ভাবে বলতে পারবে না। পুঁথি সাহিত্য কিভাবে পাঠ করা হত তাও তারা বলতে পারবে না। তবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের দু-একটি সিনেমাতে পুঁথি পাঠের কিছু অংশ দেখিয়েছেন। বর্তমানে এর প্রচলন বলতে কেবল মাত্র কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ছাড়া আর কোথাও চোখে পড়ে না। আমরা জানি পুঁথি সাহিত্য পল্লী সাহিত্যের একটি অংশ। যারা এই পুঁথি সাহিত্যের কাহিনীগুলো লিখতো তাদের শায়ের বলা হয়। আজ পুঁথি সাহিত্যের প্রচলন না থাকার পিছনে যে কারনটি দায়ী তা হলো-
প্রথমত: পুঁথির কাহিনীগুলো অনেক পুরাতন। এই পুরাতন কাহিনী গুলো কেউ শুনতে আগ্রহী নয়।
দ্বিতীয়ত: ভাল শায়ের-এর অভাব। তৃতীয়ত: আমাদের দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেলের ব্যাপক প্রসার। যা আমাদের সব সময় বিনোদনমুখী করে রাখছে। তাছাড়া শহুরে সাহিত্যের করাল গ্রাসে বর্তমানের পুঁথি সাহিত্য বিলুপ্তির পথে। পুঁথি সাহিত্যের ছন্দ গুলো কেমন তা বোঝানোর জন্য নমুনা স্বরুপ একটি পুঁথি পাঠের সামান্য কিছু অংশ পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি।
বাংলাদেশী ভাইয়েরা শোন নিবেশিত মনে,
দেশীয় সংস্কৃতির গল্প বলিব এই ক্ষণে।
গ্রামের বাড়িতে দেখি সেদিন সকালে উঠিয়া
একদল শিশু গান গাহিয়া যায় ধান ক্ষেত ছুটিয়া।
কিন্তু তাহাদের গানের ভাষা অপরিচিত ছিল,
অপরিচিত ভাষায় তাহারা সবাই গান ধরিল।
দল বাঁধিয়া গেল সবাই সেচ্কলের কাছে,
গেলাম আমি কৌতুহলে তাহাদের পাছে পাছে।
সেচকলেরই জলে তাহারা মুখ ধৌত করিল,
সাথে সাথে তাহারা আবার গানের সুর ধরিল।
তাহার পড়ে শিশুগুলি বসে সবুজ ঘাসে,
ততক্ষণে আসিলাম ভাই তাহাদেরি পাশে।
নিকট হইতে শুনি যখন তাহাদের মুখের গান,
অচমকাই কাপিয়া উঠে দেহ মন প্রান।
অবিরত হিন্দি ইংলিশ গাহিতে তাহারা থাকে,
ফাঁকে ফাঁকে জোড় গলায় শিলা শিলা বইলা ডাকে।
বুঝিলাম যখন চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটিল,
গ্রামে গঞ্জেও শিলা তাহার জায়গা করিয়া নিল।
বহু আগেই কাজলা দিদি নিল বিদায় দেশে,
হইল জায়গা কাজলা দিদির বইয়ের পাতা শেষে।
পাঠকগণ আজও সময় আছে বিদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেলের এই বিনোদন গুলোকে বর্জন করে আমাদের গ্রামীন লোককাহিনী গুলো ফিরিয়ে আনি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা এই পুঁথি সাহিত্য সম্পর্কে এখনই সচেতন করে গড়ে তুলতে না পারলে তারা এই পুঁথি সাহিত্যকে চিরতরে ভুলে যাবে। আর এ জন্য আমরা নিজেরাই তাদের কাছে দায়ী থাকবো। আমাদের সকলের প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই পুঁথি সাহিত্য তার প্রাণ ফিরে পেতে পারে। তাই আসুন আমরা এই পুথি সাহিত্যকে আমাদের হৃদয়ে স্থান করে দিই।
-দেওয়ান আবু হুরাইড়া (বাদশা)
প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক
মাইক্রোসফট এডুকেশন এন্ড কম্পিউটার সেন্টার
বদলগাছী, নওগাঁ।