ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সোমপুর বিহার
|বাংলার মসনদে তখন পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল আসীন। ধর্মপাল তাঁর শাষনকালে রাজ্য, শিক্ষা, ধর্ম বিস্তারে মন দেন। অষ্টম শতকের শেষের দিকে ধর্মপাল এ বিহার নির্মান করেন। খননকালে প্রাপ্ত মাটির সীলমোহর থেকে সোমপুর বিহার নাম পাওয়া যায়। শত শত বছর ইটেরস্তুপের উপর মাটি জমে জমে অযতেœ তৈরী হয় এক পাহাড় যার ফলশ্রুতিতে এর নাম হয় পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার। ১৯২৩ সালে বিহারের এর প্রথম খনন কাজ শুরু হয় এরপর কিছুকাল বিরতির পর ১৯২৫ সালের পুনরায় শুরু হয় খনন কাজ যা পরবর্তীতে ১৯৩৪ পরিচালনা করা হয়। ১৯৩৪ সালের খননে সত্য পীরের ভিটার সন্ধান পাওয়া যায়, যা যাদুঘরের পাশে অবস্থিত। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১৯৮১-৮৩ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ‘নতুন তথ্যের অনুসন্ধান এবং ইতোপূর্বে দীক্ষিতের আবিষ্কৃত কক্ষসমূহের প্রাপ্ত নিদর্শনাবলী সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উদ্দেশ্যে খনন কাজ শুরু করে। ১৯৮৭-৮৯ সালে পুনরায় খনন পরিচালিত হয় এবং বিহারে অঙিনা থেকে অপ্রয়োজনীয় স্তূপীকৃত মাটি অপসারণ করা হয় ব্যবস্থা করা হয় এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় যাতে বিহারে বিদ্যমান জলাবদ্ধতা দূর হয়। ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়। নরওয়ে সরকারের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের তত্বাবধানে এখানে ১৯৯৩ সালে জাদুঘর তৈরী হয়। যা ১৯৯৫ সালে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এ বিহারের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৯২২ফুট পূর্ব পশ্চিমে ৯১৯ ফুট। আয়তনে এ বিহারটিকে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। প্রায় ৪০একর জমির উপর দূর্গাকারে তৈরী এ বিহারটিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য ছিল বাসযোগ্য ১৭৭টি কক্ষ। নয় ফুট চওড়া বারান্দা বিশিষ্ট ভিক্ষুদের বাসের কক্ষ গুলো আয়তন ১৩/১৩ফুট। বিহারটির উত্তর দিকে রয়েছে প্রধান প্রবেশ পথ যা পেড়িয়ে মূল বিহারের আঙিনায় যেতে হয়। সমতল ভূমি থেকে মূল বিহারটির উচ্চতা প্রায় ১৫০ফুট। বিহারের গায়ে এখনও শোভিত রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবী ও পশুপাখির পোঁড়ামাটির ফলক। মূল বিহারের নিচের দিকে এর সাঁরি এবং উপরের দিকে দুই সাঁরির পোঁড়া মাটির ফলক ছিল। বিহারের নির্মাণকালে এসব ফলক লাগানো হয়। মূল বিহারের চারপাশে রয়েছে চারটি উপাসনা কক্ষ যেখানে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি শোভা পেতো। বিহারে খননকালে মাটি থেকে পাওয়া বেলে পাথরের চামুন্ডা মূর্তি, শীতলা মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণুর খন্ডাংশ, হরগৌরীর ক্ষতিগ্রস্থ মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের লক্ষ্মী নারায়নের ভগ্ন মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের উমা মূর্তি, বেলে পাথরের গৌরী মূর্তি, বেলে পাথরের বিষ্ণু মূর্তি, নন্দী মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণু মূর্তি, সূর্য মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের শিবলিঙ্গ, বেলে পাথরের মনসা মূর্তি সহ বিভিন্ন তৎকালীন তৈজসপত্র বিহারের জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা প্রশাসনের অধীনে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে বর্তমানে কাস্টোডিয়ানের দায়িত্বে রয়েছেন জনাব মাহবুব উল আলম। সাউথ এশিয়া ট্যুরিজম ইফ্র্যাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অধীনে বর্তমানে বিহারটির সংস্কার কাজ চলছে। হাজার বছরের ইতিহাসের এই বিহার কতশত স্মৃতির সোনালী সাক্ষী তা বিহারটির প্রতিটি ইটে লিখা রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। প্রত্নতত্ত্বের এ অমর র্কীতি যেন বারংবার ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয় বাঙালি স্বত্তাতে পরম তৃপ্তিতে।
-মো. আরমান হোসেন