নাহিদদের প্রতি ভালোবাসা

ছেলেটার নাম নাহিদ। কথা বলতে পারে না সাথে শারীরিক ভাবেও প্রতিবন্ধি সে। যদিও কথা বলতে না পারাটা ওর আর আমার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে কখনোই বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে নি। নওগাঁ সরকারি কলেজে প্রায় প্রতিদিনই নাহিদকে দেখা যায়। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা চেয়ে সেই টাকা দিয়েই ওর খাবার সংস্থান হয়। কলেজে গেলে এই একটা ছেলের খোঁজ আমি করি। বিভিন্ন সময় দেখা হয় নাহিদের সাথে। কথাও হয় ইশারায়। ইশারায় হলেও ওর প্রায় সব কথাই আমার বোধগম্য হয়। আমার উপর তার বিশাল অধিকার! দেখা হলেই আমাকে টেনে খাবারের দোকানে নিয়ে যায়। দুজন মিলে অল্প স্বল্প খাওয়া দাওয়া চলে মাঝে মাঝে। আমার কাছ থেকে ১০টাকার কমে কখনোই নেয় না। যদি কোনদিন বলি আমার কাছে টাকা নাই তাহলে নিজের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়।

সেদিন টেস্ট পরীক্ষা শেষ করে ওর সাথে কথা বলছিলাম। আমার এক বন্ধু পরে আমাকে বলে যে “তুই কি পাগল নাকি রে আজ দেখলাম একটা পাগলের সাথে কথা বলছিস।” আমি ওকে বলেছিলাম, আমরা পাগল যারা ওদের পাগল মনে করে বুঝতে চেষ্টা করি না, আমরা বাক-প্রতিবদ্ধি যারা ওদের কথা বুঝতে পারি না! প্রতিবন্ধি তারা যারা হাত থাকা স্বর্তেও মানুষের কাজে হাত বাড়িয়ে দেয় না, তারা প্রতিবন্ধি যারা তাদের নিজের কথা ছাড়া কোন কিছু ভাবতে পারে না।

আচ্ছা বলুন তো, সে জীবনের কি মূল্য যে জীবন জীবনের মূল্য বোঝে না? কারোর মধ্যে মনুষ্যত্বের স্বত্তার প্রতিচ্ছবি সবাই প্রতিবিম্বত করতে পারো না। সার্থহীন ভাবে কিছু দানের নামই জীবন। এটা নিশ্চিত থাকুন পৃথিবী আপনাকে শূন্য হাতেই ফেরত পাঠাবে। আপনি চাইলেও এক কানাকড়িরও নিয়ে যেতে পারবেন না। তাহলে এতো অহমিকা কেন বলতে পারে।
সহমর্মি হোন কেননা ওরা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। ওদের জন্য আপনার বিবেক না জাগলে আপনি কিভাবে সুস্থ হিসেবে নিজেকে দাবী করছেন বলুন? আজ দেখা হয়েছিলো নাহিদের সাথে। আমরা চটপটি খেতে বসেছি পেছন থেকে নাহিদের আগমন। আমি বললাম খাবি? ইশারাই সে জানালো সে ফুচকা খাবে! আমি ভাইকে বললাম একপ্লেট ফুচকা তৈরী করুন। ফুচকাওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, অ্যাঁ! আমার কথাতে বিস্মিত হয়েছেন বুঝলাম। আমি দিন দিন দ্রুত দিন আমাদের জন্য ফুচকা।

নাহিদের দিকে ফিরতেই নাহিদ আমার রোদচশমা পরবে বলে ইশায় জানাচ্ছিলো। চশমা পরিয়ে দিতেই নাহিদের ইশারা ওর ছবি তুলতে হবে। ছবি তোলা হলো। ছবি তোলার শেষে আমার সঙ্গে থাকা ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে কলম নিয়ে হাতে আঁকিবুকি করে দিলো। কি লিখলো শুরুতে বুঝতে পারি নি, পরে খেয়াল করে নাহিদ হয়তো ওর অজান্তেই আমার হাতে আমার নামের প্রথম অক্ষর লিখে দিয়েছে। আমি অবাক হলাম। ফুচকা খাওয়া হলো তিনজন মিলে। এদিকে ফুচকাওয়ালা ভাই আমাদের ছবি তুলছিলেন আপন মনে। আশেপাশের শিক্ষার্থীরাও আমাদের খেয়াল করছিলো সবার হাসির শব্দে তাও বোঝা যাচ্ছিলো। আমরা এসব আমলে নেই না আমরা আমাদের মতো কে কি ভাবলো এ নিয়ে আমাদেও কোন মাথা ব্যাথা নেই কখনো ছিলোও না।20161025_134709

20161025_135605ফুচকা খাওয়া শেষ হতে দেরী হলো না আমাদের। আমি নাহিদ বললাম দেখি রে ব্যাগটা টাকা দিই এখান থেকে। সংকোচ ছাড়াই ওর ব্যাগটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। ওর ব্যাগটা হাতে নিয়ে আমি আবার ফিরিয়ে দিলাম। আমাদের সময় না থাকায় ফিরে আসার প্রয়োজনে আমাদের উঠতে হলো। নাহিদ এগিয়ে এলো হাত বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। আমি জানি এর অর্থ কি! হাত মিলিয়ে আবারো হাত পেতে রইলো। হাতের ইশারাই বুঝালো ৫টাকা আমার ওকে দিতে হবে। ফুচকাওয়ালা ভাই নাহিদকে একটু ধমকের সুরে বললেন, ওই কেবলই তো তোকে খাওয়ালো আবার টাকা কিসের? আমি ভাইকে থামিয়ে তাকেই বললাম টাকা দেয়ার জন্য। আমার কথাতে ফুচকাওয়ালা ভাই টাকা দিলেন নাহিদকে। যাবার সময় আমাকে স্যালুট করে চলে গেলো নাহিদ। আমি অবাক হলাম নাহিদের স্যালুট করা দেখে। তাকিয়ে রইলাম নাহিদের চলে যাবার পথে দিকে! অপরিকল্পিত কল্পনার আবহ মিশে ওর পথকে অনন্য সাধারণ করে তুলেছে।

 

-মো. আরমান হোসেন

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক

আলোর সন্ধানে

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *