আমার লাশ

আমার লাশকর্মব্যস্ত জীবনে আবেগের ফুসরৎ মেলা দায়। কিন্তু মৃত্যুর পরেও এমন হবে ভাবিনি? সম্প্রতি  সড়ক দূর্ঘটনায় আমার মৃত্যু হয়। শরীরের তেমন কিছুই হয়নি শুধু আমি দিগন্ত পেরিয়ে, মোহ মায়া ছাড়িয়ে অন্য এক জগতে এসে উপস্থিত হয়েছি। আমার লাশটা এখন বাড়ির আঙিনায়।

আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাই আমাকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার! যদিও হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাটাই আমার ছিলো কিন্তু এখন মায়ের চোখের পানি মুছতে না পারার কষ্টে আমার বুকের ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মা, ওমা কাঁদো ক্যানো মা? এই তো আমি! এই তো তোমার আরমান? আর কেঁদো না মা! আর কেঁদো না। আমি আর সইতে পারছি না! বিধাতা আমি কি এমনটা চেয়েছিলাম? আমার আর্তনাদ কেউ শুনছে না। বাবাও কাঁদছে ডুকরে ডুকরে। আমাকে আমার মা-বাবাকে স্পর্শ করা শক্তি দাও বিধাতা । আমি এ কষ্ট নিতে পারছি না। এর চেয়ে তুমি আমাকে নরকে পুড়ে ছাঁই করে করে শাস্তি দাও কিন্তু মা-বাবার চোখের জল আমি আর সইতে পারছি না।

মা আমি আর বেশি বেলা অবধি ঘুমিয়ে থাকবো না। আব্বা, আমি আর তোমার কাছে ক্যামেরা কিনে দিতে বলে বিরক্ত করবো না। তোমাদের না বলে দূরে কোথাও যাবো না, রাত বিরাতে ঘুরবো না তবু তোমরা কেঁদো না।

পুলিশ আমার নিথর দেহটা রাস্তার পাশ থেকে উদ্ধার করে। লাশের খানিক দূরে আমার ম্যানিব্যাগে থাকা কার্ড দেখে গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় থানা মারফত লাশ হস্তাতর করে। ঢাকায় একটা কনফারেন্স এ যাবার পথে আমাদের বাসটা দূর্ঘটনার কবলে পরে। অনেকেই আহত হয়েছে কিন্তু নিহত কেবলই আমিই। বন্ধুরা আমাকে মাফ করে দিও তোমাদের প্রোগ্রামটাতে যেতে পারলাম না।  কি ভাবছি এসব! সব জলে যাক? এখন প্রোগ্রাম দিয়ে কি হবে? আমার এতো অর্জন সব এখন কি কাজে লাগবে? সবাই দুদিন মনে রাখবে, দু-চারটা শোক আর স্মরণসভা হবে তারপর সব আগের মতোই। হয়তোবা আলোর বন্ধুরা আমাকে আজীবন অন্তরের লালন করবে।

লাশ নিয়ে সকল কার্যক্রম সম্পন্ন  করতে করতে দুইদিন পাড় হয়ে গেছে। ময়না তদন্ত ঢাকাতেই হয়েছে আমার। সেকি কষ্ট মা, তুমি যদি জানতে? এরা পশুর মতো আমার লাশটাকে কেটে কেটে কুঁচি কুঁচি করে ফেললো। আমি এতোবার করে বললাম, আমার কিছু হয়নি, শুধু মাথায় আঘাতের একটা ক্ষত আর হার্ডটা হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। ওরা শুনলো না আমরা কথা! তোমার সোনার ছেলেটার গায়ের কি হাল করেছে তাকিয়ে দ্যাখো! ছোটবেলায় কপালে হাত দিয়ে যেমন করে জ্বর দেখতে তেমন করেই হাত রেখে দ্যাখো কপালটাও ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে ওরা। অযথা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, ডাক্তারগুলো! আমি বারবার বলছিলাম এটা সাধারণ একটা র্দূঘটনা; ওরা শুনলো না মা? কেটে কুটে ছিন্নভিন্ন করে দিলো আমাকে। ম্যানিব্যাগটা না থাকলে বোধহয় আমাকে এতোটা কষ্ট পেতে হতো না মা? তাহলে পরিচয় পেতোও না আর…! এখন তথ্য প্রযুক্তির যুগ, হয়তো পরিচয় পেয়েই যেতে কোনোভাবে অথবা এতো খাটুনি না করে বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দিয়ে দিতো কোন নির্জন দমবন্ধ করা স্থানে। তুমি তো জানো মা অচেনা পাখির ডাকে আমার বড়ো ভয়। নিস্তব্ধতার কাহিনী আমার শ্বাসরোধ করে ফেলে। অবশ্য এখন এসব বলে লাভ কি? আমি তো একটা অনুভূতি মাত্র। কদিন পরেই সব যুগের যান্ত্রিকতায় বিলীন হয়ে যাবে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক! যান্ত্রিকতার যুগে আবেগি মানুষেরা কবি,সাহিত্যিক, লেখক, অথবা সমাজসেবী হয় নইলে অকর্মন্য অপদার্থ। আবেগ দিয়ে আর কিছুই চলো না এযুগে। শুধূ আমরা কিছু বস্তাপঁচা আবেগি মানুষ রয়েছি যারা নিজের খেয়ে অন্যের জন্য ভাবি।

ভাই-ভাবি এসেছে। ওরাও কাঁদছে। মা আমার খাটিয়া ধরে বিলাপ করছিলো ভাই-ভাবি এসে পরায় মা ওদের জরিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। ভাই তুই ও কাঁদছিস? তুই অন্তত আমাকে বোঝ? এইতো আমি? মাকে একটু বুঝিয়ে বলনা ভাই। তোর দেয়া কম্পিউটার, মোবাইলসহ সব কিছুতে আমার আর অধিকার রইলো না! ভাই, তুই না বলেছিলি, সাদা পোষাকে আমাকে অনেক সুন্দর লাগে! দ্যাখ, আমার দিকে আমি কি সুন্দর সাদা পোষাক পরে আছি। এর চেয়ে সাদা আর পৃথিবীতে হয় না। আমার মুগ্ধ চাচ্চুটা কাঁদছে ক্যানো? আমি যে চলে গেছি ওকে কেউ বলিস না! অবশ্য এমনিতেই বুঝে যাবে কিছুদিনে? শেষবার যখন মুগ্ধ’র সাথে দেখা হয়েছিলো তখন ওকে ওর পছন্দের চকোলেটটা কিনে দিতে পারিনি। এবার কথা দিয়েছিলাম ঢাকা থেকে ফেরার পথে অনেক অনেক চকোলেট নিয়ে আসবো কিন্তু আর তো ফেরা হলো না আমার। আমার বড়ো আব্বা আমার জন্য কবর তৈরী করছেন! এটা এখন থেকে আমার নতুন আবাস।

বড়ো আব্বা এলাকার প্রায় অধিকাংশ মানুষের কবর খুঁড়েছেন। দাদা-দাদীরটা আর এখন আমারটা!! আমাকে বড়ো আব্বা হুুটহাট কাজের জন্য পাগল বলতেন কিন্তু আজ আর আমাকে ডাকছেন না ওই নামে! আমার অস্তিত্ব আজ পৃথিবীর বাতাসে অদৃশ্য তাই আমি শুধূই স্মৃতির সীমায় আবদ্ধ। অনেকেই খবর পায় নি আমার মৃত্যুর; সংবাদ পেলে শুধু শুধূ কষ্ট বাড়তো? অবশ্য এখন আমার কষ্টের কোনো মূল্য নেই। ভালোই হলো, অর্জনের নেশায় ছুটে চলতে চলতে যান্তিক হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে কি হবে জানিনা তবে সাধের দেহ ছেড়ে আজ আমি মুক্ত!  মায়ের বিলাপ কানে আসছে “ও সোনার ময়না রে, কে হামাক মা কয়ে ডাকপে রে?” বাড়িতে সবাই কাঁদছে, সাথে আমিও কাঁদছি অদৃশ্য অনুভূতিতে..। মায়ের চোখদুটো কেঁদে কেঁদে রক্তবর্ণ। আমাকে কবরের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে, মা চিৎকার করে খাঁটিয়া চেপে ধরে। মায়ের বুকের ধন হারিয়ে গেছে, মা চিৎকার করে বলছে “ও আল্লা হামার জীবন লিয়ে হামার ছলডার জীবন ফিরাইয়া দাও!! এ এক মায়া বাঁধন। যে বাঁধনে আসতে যতটা কষ্ট তাঁর চেয়ে বেশি কষ্ট ছেড়ে যেতে? মা-বাবা, ভাইবোনকে নিজের মৃত্যুতে কাঁদতে দেখা যে কি কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না।

আব্বা,বড়ো ভাই, ছোট ভাইসহ সবাই মিলে আমাকে কাঠের খাঁটিয়াতে করে কবরে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মায়ের গগন বিদারী আর্তনাদ পেছনে ফেলে খাটিয়া কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলল সবাই। আমি খাঁটিয়ার সাথে সাথে এগিয়ে চললাম। খাঁটিয়া ততক্ষণে আঙিনা পেরিয়েছে, মাকে দেকলাম ছুটে আসতে, মা এসে বিলাপ করে “আমার মানিকটারে শেষবারের মতো একবার দেকপার দাও রে, আর একবার দেকপার দাও?” বলছে আর ছুটে আসছে।

খাটিয়া বাহীরা থমকে দাঁড়ালো আব্বার নির্দেশে, আব্বার চোখে অবিরাম কান্নার জল ঝরছে, আব্বা চোখের জল মুছলেন। মা পাগলের মতো ছুটে আসলো খাটিয়ার দিকে! খাটিয়া থামানো হলো, কাফনের কাপড় সরিয়ে উন্মোচিত করা হলো আমার কাঁচাছেড়া মুখ। লাফিয়ে পড়লো মা খাটিয়ার দিকে অনবরত চুমো দিতে লাগলো মা আমার কপালে, হাত বুলাতে লাগলো আমার কপালে! আব্বা এবার একটু সবাইকে কড়া নির্দেশের মতো করেই বললেন খাটিয়া তোলো অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমরা ভাবিরা মাকে ধরে খাঁটিয়া থেকে তুললেন। খাটিয়া এগিয়ে চলল কবরস্থানে..। আমার দাদার পাশের কবরটা আমার । কবরে দাদার পাশে থাকলে অনেক কিছু জানা যাবে এ প্রজন্ম আর ওই প্রজন্ম সম্পর্কে যদিও সেটা কাউকে হয়তো বলতে পাররো না। আমাকে কবর দেয়ার কাজ শেষ হলো। আমি এখন কবরে শায়িত, মায়ের কান্নার শব্দ এখনো কানে আসছে। হঠাৎ গম্ভীর গলার পাশ থেকে আওয়াজ আসলো, “কি রে আরমান নাকি?” ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে দেখি শক্ত সামর্থ্য, সুন্দর একজন মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বুঝতে বাঁকি রইলো না তিনি কে?

 

-মো. আরমান হোসেন

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক

আলোর সন্ধানে

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *