বিলুপ্তির পথে ঐতিহাসিক হলুদ বিহার

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্বিক নির্দশন। প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন সমৃদ্ধ জেলা নওগাঁ। নওগাঁর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী বিভিন্ন ঐতিহাসিক সব নির্দশন। হলুদ বিহার বাংলাদেশ প্রত্নত্বাত্তিক অধিদপ্তর স্বীকিৃত একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থান। হলুদ বিহার ঐতিহাসিক সোমপুর বিহার হতে প্রায় ১১/১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং মহাস্থানগড় হতে পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে; নওগাঁর বদলগাছী উপজেলাধীন বিলাশবাড়ী ইউনিয়নের দীপগঞ্জ গ্রামে অর্ন্তগত প্রত্নস্থল।

বর্ষাকালে হলুদবিহার ঢিবিটি দ্বীপের ন্যায় দেখাতো যায় ফলশ্রুতিতে বর্তমানে এটি দ্বীপগঞ্জ নামে পরিচিত। দ্বীপগঞ্জ গ্রামের হাটের পাশে স্তুপীকৃত মাটির ঢিবি সবার দৃষ্টি আর্কষণ করে। এ ঢিবির পরিধি প্রায় ১০০ফুট এবং সমতল ভূমি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। প্রত্নতত্ব বিভাগের অনুসন্ধানে এটি একটি বৌদ্ধ বিহার বলে ধারণা পাওয়া যায়। কিছু কিছু ঐতিহাসিকরা এটিকে পাহাড় পুর বৌদ্ধবিহারের সমসাময়িক বলেই মনে করেন। তবে এর নিমার্ণে শুধু সিঁড়ির ইটের সঙ্গে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরের পশ্চিম পাশের ইটের মিল পাওয়া যায়। হলুদ বিহারের একটি প্রাচীন পথ কোলা অতিক্রম করে পাহাড়পুর, আরেকটি পথ জগদ্দল মহাবিহারের অগ্রসরমান। অবস্থাদৃষ্টে এ বিহার তিনটির মধ্যে গভীর যোগাযোগ ছিল বলে ধারণা করা হয়।

HaludViharaভারতের প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগের জি.সি দত্ত ১৯৩০-৩১ সালে স্থানটি পরিদর্শনকালে লক্ষ করেন যে, এটি  পূর্ব-পশ্চিমে ৬৪.৫ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৪০.৫ মিটার এবং সংলগ্ন ভূমি হতে এর উচ্চতা প্রায় ১০.৫ মিটার। ১৯৬৩ সালে স্থানীয় কিছু জনগন ইঁট সংগ্রহকালে কৃষ্ণ পাথরের একটি বৌদ্ধ মূর্তির একাংশসহ কয়েকটি মৃৎফলক আবিস্কৃত হয়। কাজী মেছের এ অঞ্চল পরিদর্শন করে পাথরের একটি ভগ্ন বৌদ্ধমূর্তি ও পাহাড়পুর রীতির কয়েকটি পোড়ামাটির ফলক উদ্ধার করেন।  বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হারুনুর রশীদ ১৯৭৪ সালে এ এলাকাটি পরিদর্শন করেন এবং দেখতে পান যে, হলুদ বিহার গ্রামের দক্ষিণপূর্ব দিকে এক বিশাল পুরানো দিঘির চারপাশে অসংখ্য নিচু টিবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তিনি এ বিহারের নিকটবর্তী একটি বাড়ি হতে পাহাড়পুর রীতির কয়েকটি পোড়ামাটির ফলক ও পাথরের ভাস্কর্য দেখতে পান।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ব বিভাগ হলুদ বিহারকে সংরক্ষিত মনুমেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রথমে ১৯৮৪ সালে এবং পরে ১৯৯৩ সালে এটি খনন করে। খনন কার্যের ফলে একটি মন্দির কমপ্লেক্স আবিষ্কৃত হয়। কমপ্লেক্সটি প্রতি পার্শ্বে ৫.৮০ মিটারের  একটি নিরেট বর্গাকৃতির ভিত্তি (সম্ভবত এটি একটি স্তূপের ভিত্তি ছিল), দুটি অসমান আয়তকার কক্ষ, একটি সিঁড়ি ও কমপ্লেক্সের বেষ্টনী দেয়ালের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। ৫.৫৫ মিটার ঢ ৩.২০ মিটার এবং ২.৬ মিটার ঢ ১.৬ মিটার আয়তনের কক্ষ দুটির মধ্যে ক্ষুদ্রাকার কক্ষটি ছিল খননকারীদের মতে মন্দির, যেখানে নিরেট ভিত্তির দিকে মুখ করা একটি বড় পাথরের মূর্তি স্থাপিত ছিল।

অন্যদিকে বৃহত্তর কক্ষটি একটি মন্ডপ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। এ ভবনের চারপাশে ১.১ মিটার প্রশস্ত হাঁটাচলার একটি পথ ছিল। মন্দির  কমপ্লেক্সের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি অভিক্ষেপের ধ্বংসাবশেষ অংশত উদঘাটিত হয়েছে। অভিক্ষেপের দিকে একটি ইট বাঁধানো পথ দক্ষিণ দিক থেকে প্রবিষ্ট ছিল। এর কয়েকটি স্থানে সর্বোচ্চ ৬.১৫ মিটার গভীরতায় খনন কার্য আট স্তরে সম্পন্ন হয়েছে। এ সকল স্থান হতে বেশ কিছু প্রাচীন নিদর্শনাদি ও সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। এখানে আরও পাওয়া গেছে খোদাইকৃত পোড়ামাটির সিল, অলংকৃত ইট, মানুষের মূর্তি সম্বলিত বেশ কিছু ভাঙ্গাচোরা পোড়ামাটির ফলক সহ পাথরের সামগ্রীসমূহের মধ্যে একটি মূর্তির স্তম্ভমূল, অলংকারের ঢালাই ছাঁচ এবং চূর্ণনযন্ত্র উল্লেখযোগ্য।Photo 3

হলুদবিহারে সীমিত খননকার্যে যে সকল দর্শনীয় সামগ্রীর সন্ধান পাওয়া গেছে তা এখানে মধ্যযুগের বেশ সমৃদ্ধিশালী বৌদ্ধ বসতির অস্তিত্ব নির্দেশ করে। এ প্রাচীন স্থানটির শনাক্তীকরণ এখনো নিশ্চিত করা হয়নি, দুষ্পাপ্য নির্দশন সমূহ উৎসাহব্যঞ্চক সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও বর্তমানে এ বিহারটির অবস্থা অতিশয় করুণ। অতীত হতে বিহারটি বিভিন্ন সময় প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ স্থানীয় জনগণের দ্বারা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত এটির ক্ষতি সাধন হচ্ছে।

প্রতিনিয়ত বসছে হলুদ বিহারে গাঁজার আসর দেখা কেউ নেই। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তাঁদের সাইবোর্ড ঝুলিয়ে দায়িত্ব পালন করেছে!! ইতিহাসের সাক্ষী এ বিহারের বিলুপ্তিতে কারোর মাথা ব্যাথা নেই। বিহারের খনন প্রত্ন সামগ্রী উদ্ধারে সামান্যতম উৎসাহও পরিলক্ষিত হয়নি দীর্ঘদিনেও। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অবহেলার কারণে দিনের পর দিন ধংস প্রাপ্ত হয়ে বিলুপ্তি পথে হলুদ বিহার। সরকারের উচিত যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে কালের সাক্ষী এ ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব নির্দশনকে বাঁচিয়ে রাখা।

(তথ্য সূত্র: রবীন্দ্র জার্নাল, নওগাঁ মহকুমার ইতিহাস, বদলগাছী উপজেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, নওগাঁ ভ্রমণ, বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া , দৈনিক জনকন্ঠ, জাতীয় তথ্য বাতায়ন।)

-মো. আরমান হোসেন

প্রতিষ্ঠাতা

আলোর সন্ধানে

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *