না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন সাদা মনের মানুষ হারান চন্দ্র চংদার

হারান স্যারও হারিয়ে গেলেন৷ চোখদুটো আর বাঁধ মানছে না। হৃদয় ভারাক্রান্ত। আজ ৮ মার্চ, ২০২১ খ্রিঃ ভোর ৪-১০মিঃ (৭৭ বছর বয়সে) তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি আধুনিক  যুগের যান্ত্রিকতায় হারিয়ে যাওয়া মানুষদের দলভূক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন সাদা মনের মানুষ ।

হারান চন্দ্র চংদার ১লা জানুয়ারি ১৯৪৪ সালে বদলগাছীর ব্রজ রাখাল চংদার ও হেমনলিনী চংদার এর অতি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। বদলগাছী থেকেই তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে প্রাইভেট পরিক্ষার মাধ্যমে মাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপরে আর পড়ালেখা করা হয়ে ওঠেনি তার। ১৯৬৯ সালে বালুভরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার মাধ্যমে কর্মজীবনের সূচনা হয়। ১৯৮১ অসুকা চংদার এর সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি চাকুরি থেকে অবসর নেন।

তাঁর কাজকর্মের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত উন্নত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। যা সমাজের অতি উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষিত মানুষগুলোর মধ্যেও খুজে পাওয়া দুস্কর।সুন্দর ও ভাল মনের মানুষ হলে জিবনের সকল পর্যায়ে ভাল কাজ করা সম্ভব এ বিষয়টির অন্যতম নিদর্শন হারান চন্দ্র চংদার। তিনি ভালবাসা, দয়া ও সৌহার্দ্যরে এক অনন্য প্রতিমূর্তি। তার সেই স্বত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বালুভরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার অনন্য কিছু আচরণ সকলের নজর কাড়ে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জ্বর বা সর্দিকাশি হলে নিজের নৈতিক দায়িত্ব মনে করে ঔষধ দিতেন। তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাতে পারদর্শী ছিলেন। অসুখ গুরুতর হলে নিজ দায়িত্বে হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। শিক্ষার্থীদের কারোর কাপড় ছেঁড়া থাকলে কিংবা বইখাতা না থাকলে কিনে দিতেন নিজ অর্থায়নে। এসব জনহিতকর কাজে আত্মনিয়োগের ফলে নিজের দিকে তাঁকানোর সময় ছিলো না তাঁর। সেজন্যই আজ তাঁর শেষ আশ্রয়টুকুও নেই যেখানে তিনি বসবাস করেন সেটাও নিজের নয়।

তিনি সকল শিক্ষার্থীদের নিজ সন্তানের মত ভালবাসতেন। যেনো বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী তার নিজের সন্তান। ছোট্ট শিশুদের কষ্ট দেখতে পারতেন না একদমই। স্কুলসহ পরিচিত-অপরিচিত শিশুদের সর্দিকাশি, এমনকি তাদের মলমূত্রও পরিস্কার করে দিতেন তিনি নিজে। এ ভালোবাসার নজির অমূল্য, অনবদ্য।তিনি শিক্ষক হওয়ার পাশাপাশি সমাজসেবিও বটে। তিনি নিজ আগ্রহে গরিব অসহায় মানুষগুলোর বিয়ের আয়োজনের দায়িত্ব নিতেন। শুধু দায়িত্ব নয় আর্থিক, কায়িক, মানসিক যত ধরনের সহযোগিতা আছে তিনি তাঁর ও যোগান দিতেন।

তিনি একতা ক্লাবসহ বিভিন্ন লাইব্রেরিতে ও কাজ করেছেন। এছাড়া ও তিনি সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে মৃতদেহ সৎকার ও করান। এ পর্যন্ত তিনি ১৬৬ এরও বেশি মৃতদেহ সৎকার করেছেন। তার এ কাজ, ভাল মানসিকতা ও সৎ কাজের প্রতি মানুষকে আহবান জানানোর জন্য বিদ্যাসাগর ইন্সটিটিউট “সাদা মনের মানুষ” সম্মাননা জানায়।তার সহধর্মিণী বলেন, “যখন বিয়ে হয়ে আসি তখন রান্নাবাড়া ঘর সংসার কিচ্ছুই জানতাম না আমি যা শিখেছি সবি তাঁর কাছ থেকে। সবসময় বলত সকলকে ভালবাস। ভালবাসা দিয়ে সর্বত্ব জয় করা যায়।”

তাঁর নিজের কোন সন্তান নেই। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভাল নয় তারপরেও তিনি ভাল কাজের একটা সুযোগও হাত ছাড়া করতে রাজি নন। সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যান। ভালো কাজের জন্য তিনি হয়েছেন সমালোচিত। তার সামাজিক কার্য-কলাপের জন্য তাকে পাগলও সাব্যস্ত করেছেন অনেকে। যদিও এব্যাপারে তাঁর কোনরকম ক্লেশ বা ঘৃণা কোনটিই নেই।নিজের খাবার খাওয়া হোক বা না হোক কুকুর, বিড়াল, এমনকি পাখিদেরও ত্রিসন্ধ্যা খাবারের ব্যবস্থা করেন। এখনও নিয়মিতভাবে পশুপাখিদের খাওয়ান তিনি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো পশুপাখিরাও খেতে তাঁর কাছে আসে নিয়ম করে ।

বদলগাছীতেই তার নিজস্ব জমি আছে যা দখল করে আছে অন্যরা। এ ব্যাপারে তার কোন মাথাব্যথা নেই তার শুভকাঙ্খীরা জমি ফেরত নেওয়ার কথা বললে তিনি তা নাকচ করে দিয়ে গন্ডগোল করতে বারণ করেন বলেন, আমার জমির প্রয়োজন নেই।প্রচার বিমুখ মানুষ হারান চন্দ্র চংদার। ভালমানসিকতায় তিনি যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা বর্তমান যুগে সত্যিই বিরল।

 

এই আলোকিত  স্বত্তাকে হারিয়ে আলোর সন্ধানে পরিবার শোকাহত।

 

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *