রত্নগর্ভা মা-ড. ফাল্গুনী রানী চক্রবর্তী

মা আর মায়ের অনূভূতি আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। মায়ের অবদানেই পৃথিবীতে আসা, কথা বলতে শেখা। মা সন্তানের অভয়াশ্রম। মা-কে ঘিরেই আমাদের বেড়ে ওঠা।

আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করছি একজন স্বপ্নজয়ী মাকে যিনি ২০১৬ সালের মা দিবসে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক “স্বপ্নজয়ী মা” সম্মানে ভূষিত করা হন। এ দেশের ১৫ জনের স্বপ্নজয়ী মায়ের মধ্যে একজন নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলাধীন বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. ফাল্গুনী রানী চক্রবর্তী

তিনি রংপুর জেলার বদরগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন। তার মাতা দিপালী চক্রবর্ত্তী পিতা দ্বিজেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী। তিনি ৫ বোন ১ ভাইয়ের সবার বড়ো। ১৯৮৩ সালে তিনি বদরগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৪ সালে তিনি নওগাঁ জেলার বদলগাছীর নিমাই চন্দ্র চক্রবর্ত্তীর সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৮৬ সালে তিনি বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

১৬ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের মা হন। তাঁর তিন সন্তান। এক পুত্র ও দুই কন্যা। বিবাহ সংসার কিংবা সন্তান তাঁর শিক্ষা বা কর্মের অন্তরায় হয় নি, কারণ তিনি অত্যন্ত দৃঢ় এবং অধ্যবসায়ী ছিলেন। একইসাথে তিনি একজন দায়িত্বশীল মা। স্বামী চাকরি সূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় অধ্যয়নের স্বপ্ন দেখতেন। ভর্তির সুযোগও পেয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি দুই সন্তানের জননী।

ঢাকায় সন্তানসহ থাকা কিংবা সন্তানদের রেখে ঢাকায় পড়া কোনোটাই সম্ভব ছিল না। সংসারে একমাত্র উপার্জন কর্তা তাঁর স্বামী এবং সেই উপার্জনেই চলত পুরো পরিবার। তাই তিনি খানিকটা অভিমানবশতই বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে একেবারে ‘বাংলা’য় চলে এলেন। তিনি যখন অনার্স ১ম বর্ষের ছাত্রী তখন তাঁর ১ম সন্তান ১ম শ্রেণির ছাত্রী। ২য় সন্তান ঘরের ছাত্র। আর অনার্স পড়তে পড়তেই তিনি ৩য় সন্তানের জননী হন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মেধাবী ছাত্রী কেবল নিজেকে নিয়ে নিমগ্ন থাকেন নি। সাথে পালন করেছেন সংসারের সকল দায়িত্ব। তিনি নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন ঐকান্তিক স্থিরতায়। অত্যন্ত মিতব্যয়ী এবং শীলিত ড. ফাল্গুনী তিন সন্তানকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে নিবিড় মনোযোগী ছিলেন। পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিতে পারেন নি। কোনো সন্তানকেই কখনো প্রাইভেট পড়াতে পারেন নি। তারা নিজেদের মেধা ও মা বাবার শিক্ষায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কোনো অপ্রাপ্তির জন্যে তাদের কোনো আক্ষেপ ছিল না। পরিবারের প্রতি তারা অত্যন্ত অনুগত ছিল। ড. ফাল্গুনী বলেন, ‘ আমি আমার পড়াশুনা গবেষণা লেখালেখি এবং আমার ছেলেমেয়েরা নিজেদের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও দিনশেষে আমরা এক হতাম অন্তত খাবার টেবিলে। আমাদের সারাদিনের সমস্ত কাহিনী সেখানে উপস্থাপন হতো। আমরা ছিলাম বন্ধুর মতো। ফলে ছেলেমেয়েদের কোনো কিছু গোপনীয়তা রক্ষার চেষ্টা করতে হতো না।” তিনি আরো বলেন, আমি আজ স্বপ্নজয়ী মা হতে পেরেছি তার সবটুকু কৃতিত্ব আমার ছেলেমেয়েদের। ওরা কখনো নিজেদের কিংবা পরিবারকে ফাঁকি দেয় নি।

সন্তান ও স্বামীর সাথে ড. ফাল্গুনী রানী চক্রবর্তী ।

লেখাপড়ার পাশাপাশি সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি ইত্যাদি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চাও তাদের মন ও মেধাকে করেছে শীলিত বিকশিত। ড. ফাল্গুনীর ১ম সন্তান ঊর্মিলা চক্রবর্তী বর্তমানে নওগাঁ সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক। ২য় সন্তান একমাত্র পুত্র তন্ময় চক্রবর্তী ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ৩য় সন্তান কমলিকা চক্রবর্তী ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা বিদ্যায় অধ্যয়নরত।

ড. ফাল্গুনী একজন ব্যতিক্রমী কিশোরী মা। ১৬ বছর বয়সে তিনি মা হয়েছেন কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাঁকে আজ সন্তানসহ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। বাল্যবিবাহ, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, যৌথ পরিবারের কর্তব্য কোনো কিছুই তাঁর স্বপ্নপূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে নি। তিনি একজন বিশিষ্ট গবেষক, লেখক, অধ্যাপক এবং সমাজসেবি।

তিনি সকলের জন্যেই বলেছেন, স্বপ্ন দেখা শিখতে হবে, স্বপ্ন লালন করে তা পূরণের জন্যে থাকতে হবে একনিষ্ঠ। নারী নয়, নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে। সম্মান বা অধিকার অর্জন করে নিতে হয়।

সদালাপি ও প্রাণবন্ত ড. ফাল্গুনী রানী চক্রবর্তী নিজের সৌভাগ্যকে স্বকীয়তায় অর্জন করেছেন তাই আলোর সন্ধানে পরিবার গর্বিত। তাঁর গর্ভে  ধারণকরা রত্নরা এখন সমাজের বিভিন্নপ্রান্তে আলো ছড়াচ্ছেন। এই আলোর রশ্মি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাক সেই কামনা করছি। আলোর সন্ধানে এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাঁকে রত্নগর্ভা মা সম্মানে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে।

আলোর সন্ধানে’র পক্ষ থেকে রত্নগর্ভা মায়ের প্রতি রইলো অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা

 

গ্রন্থনা:

মো. আরমান হোসেন

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক

আলোর সন্ধানে

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *