চমক আছে অন্তরে…

IMG_20130101_184712গন্তব্যটা অন্যরকম! চিরতরে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সমাধিতে বন্ধুকে খুঁজতে আমরা ছুটে চলেছি। ২০১৩ সালে আলোর সন্ধানে’র দলগত লেখাপড়ার কার্যক্রমে পরিচয় হয় বন্ধুর সাথে। তারপর মাঝে মাঝেই অনিয়মিত থাকতো সে লেখাপড়ার কার্যক্রমে; দলনেতা হওয়াই অনিয়মিতদের ওপরে কিছু কিছু সময় কড়া কথা শুনাতে হতো। এভাবেই চলছিলো। বন্ধুটি একদিন আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলল “দোস্ত আমাকে যেন গ্রুপ স্ট্যাডি থেকে বাদ দিস না, আমি অসুস্থ তাই নিয়মিত আসতে পারি না।” এ কথায় ওর সাথে শেষ কথা আমার!

অসুস্থতার কথায় আমি ওর কাছে জানতেও চাইনি কি অসুখে ভুগছে সে? তারপর অনেক দিনের অনিয়মে প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়মতান্ত্রিকতার কাল ছোবলে আমাদের সবাইকে নিঃস্ব করে চিরতরে হারিয়ে গেল সে। নওগাঁ থেকে গাড়িতে করে রওনা দিয়েছিলাম আমরা প্রায় ১২টার দিকে বান্দাইখাড়া এসে পৌঁছালাম। তারপর ভাড়ায় মোটরযোগে বন্ধুর বাড়ি পৌঁছালাম আমরা( আমি আর রায়হান)।

সত্যি বলতে এরচেয়ে আর গ্রাম্য পরিবেশ আমি দেখি নি। গ্রাম বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। ১২টা ৩০ মিনিটে ওর বাড়ি পৌঁছালাম আমরা। বাড়ি পৌঁছেই রক্তবর্ন চক্ষুর আবেগি চাহুনিতে বন্ধুর বাবা-মায়ের সাথে আলাপ হলো। আমাদের দেখে বন্ধুর বাবা-মা দু জনেই কেঁদে উঠলেন। ৩বছর পূর্বে মারা যাওয়া সন্তানের বন্ধুদের দেখে নিজের হারিয়ে যাওয়া বুকের ধনের কথা ভেবে মা-বাবার মন কেঁদে না উঠে পারে না। আবার যদি ছেলের বন্ধু মৃত ছেলের মতো দেখতে হয় তাহলে কষ্টের সীমা থাকে না। ছেলের মৃত্যুতে কেঁদে মনকে স্বান্তনা দেয়া বাবা-মায়ের কাছে অনেক কষ্টের। পৃথিবীতে যে বাবা-মা’র সন্তান তাঁদের ফেলে না ফেরার দেশে চলে যায় তাঁরা জীবন্ত লাশ হয়ে যায়।

বন্ধুর বাবার কান্নাতে আমরা নিজেকে ধরে রাখতে পারি নি। পরম শ্রদ্ধায় আমরা দুজনই তাঁর কাছে গিয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়েছি । বোধকরি কোন বাবা-মায়ের স্নেহেরন মধ্যেই কোন পার্থক্য নেই। আমি আজ তাঁদের স্নেহের মধ্যে কোন ভিন্নতা খঁজে পাই নি। গ্রাম্য পরিবেশ গৃহস্থ বাড়ী। বাড়ীর সবকিছুই আলুথালু হয়ে আছে এখানে সেখানে। আমাদের দেখে বন্ধুর মা চোখ মুছতে মুছতে রান্না ঘরে চলে গেলেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে রান্না ঘরেই মা সারাক্ষণ নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন; কেননা তাঁর ছেলের সহপাঠীরা এসেছে।

বন্ধুর ৪ভাই ১ বোন, সে বাবা-মা সেজ ছেলে। মা-বাবাকে যার পর নাই ভালোবাসতো সে। ভদ্র, নম্র, শান্ত সকল বিশেষণ দিয়েই তাঁকে বিশেষায়িত করা যায়। মাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না সে। বাড়ির চৌকাঠ পেরুতেই মায়ের খোঁজ করতো সে। বাবার কাজে সহযোগিতায়ও সে ছিলো সিদ্ধহস্ত, কৃষি কাজে জমি জমার ফসল সংক্রান্ত কার্যাদিতে সবসময় সাহায্য করতো সে।

উচ্চবিলাসীতা ছিলনা তাঁর ধাঁচে সবসময় সময়ের মূল্য দিয়ে চলাতেই স্বাচ্ছন্দ্য ছিল তাঁর। একথায় পরিবারের সোনার ছেলে ছিলো। আমাদের পরিচয় হয় আলোর সন্ধানে’র দলগত লেখাপড়ার মাধ্যমে। যার ফলশ্রুতিতেই বন্ধুত্ব। বন্ধু হিসেবে নিবিড়ভাবে মেশার সুযোগ মিলে নি তবু যেটুকু দেখেছি তাতে সাদামাটা চরিত্রটা আমার ভেতরটায় জায়গা করে নিয়েছিল।

২০১৩ সালের নভেম্বর মাস। ব্যস্ততায় কাটছিলো বরাবরের মতো। শুনলাম আমাদের বন্ধুটিকে হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেইবারেই প্রথম জানতে পারি বন্ধুর হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে। নিজের কষ্টের কথা কখনো অন্যের কাছে বলতো না পাছে যদি কেউ কষ্ট পায়। সেই ভাবনা থেকেই আমি নিজের কষ্ট কাউকে বলি না কারণ ওই “কষ্ট”। নভেম্বরের ১৮ তারিখ ঢাকায় বন্ধুটির মৃত্যু হয়। শুনে প্রথমে বিশ্বাসই হয় নি ভেবেছি যারা এরুপ কথা বলে তারা বেজায় বাজে। পরে শুনি ঘটনা সত্যি বন্ধু আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে চিরতরে। অনেক কষ্ট পেয়েছি কিন্তু কিছুই করার ছিল না। কেননা এ অপ্রিয় সত্যকে আমাদের মানতেই হবে। বন্ধুকে সমাহিত করা হলো। মনে হচ্ছিলো হৃদপৃন্ডের একটা অংশ সমাহিত করা হয়েছে।

আজ প্রায় তিন বছর পর আবার ওকে দেখতে যাচ্ছি আমরা। কেমন আছো বন্ধু জিজ্ঞেসও করতে পারবো না আজ; তবু জানতে চাইবো ওর কবরে  “কেমন আছো বন্ধু?” এতো তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া কি দরকার ছিলো? তোকে হারানোর পর থেকে হৃদয় একবারের জন্যও তোকে ভোলেনি বিশ্বাস কর! আমরা কখনো তোকে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে দেবো। 20160606_122514

তুই ছিলি আছিস তুই থাকবি। আজীবন তোর জন্য আমাদের অনুভূতি অমলিন থাকবে। তুই যদি আমাদের অনুভূতি ওপার থেকে দেখিস তাহলেই বুঝবি আমরা কতোটা তোকে আমাদের অনুভবে ধারণ করি “চমক”।সৃষ্টিকর্তা তোকে অবশ্যই বেহেস্ত নসিব করবেন।

-মো. আরমান হোসেন

৭ জুন; আত্রাই, নওগাঁ।

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *