অটিজম

অটিজম কি?
অটিজম এবং অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার উভয়ই মস্তিস্কের বিকাশ জনিত এক শ্রেণির জটিল সমস্যা। এই বিকাশ জনিত সমস্যাগুলোর বৈশিষ্ট্য বিভিন্নরকম হতে পারে, যেমন: স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্কে অসুবিধা, কথার মাধ্যমে বা ইশারায় ভাব প্রকাশে অসুবিধা এবং একই আচরণের পুনরাবৃত্তি করার প্রবণতা । অটিষ্টিক ডিজঅর্ডার, রেট সিন্ড্রোম, শৈশবে ক্রমহ্রাসমান বুদ্ধিমত্তা, পারভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং এ্যাসপারজার সিন্ড্রোম বলতে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য গুলোকে বুঝায়। বয়স উপযোগী বোধগম্যতা/বুদ্ধিমত্তা, অঙ্গ সঞ্চালনে সমস্যা, মনোযোগের অভাব এবং শারীরিক সমস্যা যেমন- হজম ও নিদ্রা জনিত সমস্যা প্রভৃতি ও অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার এর অন্তর্ভূক্ত। তবে এএসডি (অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার)আছে এমন ব্যক্তিদের কারো কারো দেখে মনে রাখা, গান, শিল্পকলা-ছবি আঁকা এবং গনিত বিষয়ে অত্যন্ত/চরম প্রখরতা থাকে ।
মস্তিস্কের প্রাথমিক বিকাশকালীন সময়ে অটিজমের সূচনা হতে পারে । তবে অটিজমের বেশিরভাগ লক্ষণ সমুহ সাধারণতঃ ১২-১৮ মাস বয়সেই শিশুদের মাঝে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় । কেউ কেউ দ্বিতীয় বছর পেরুনোর আগে পর্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে ওঠে, কিন্তু এরপর তারা তাদের স্বাভাবিক বিকাশগত দক্ষতাগুলো হারিয়ে অটিজমের শিকার হয়- এই প্রবনতাকে রিগ্রেশন বলা হয় । গবেষনায় আরো জানা গেছে যে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অটিজম হয়ে থাকে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি । আমেরিকায় ৫৪ জন ছেলের মধ্যে ১ জন এবং ২৫২ জন মেয়ের মধ্যে ১ জনের অটিজম হয়ে থাকে। শুরুতেই অটিজম নির্ণয় করা গেলে ও অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি আচরণগত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলে শিশুর সম্ভাব্য উন্নতি পাওয়া যায় । অটিজম বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে পরিবার ও সমাজের অন্যান্যরা গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান ভুমিকা পালন করতে পারে ।

অটিজম আক্রান্ত যুবদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য:
অটিজম আক্রান্ত যুবদের প্রতি পরিবারের পাশাপাশি সমাজেরও রয়েছে দায়বদ্ধতা। আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে অটিজম আক্রান্ত যুবক/যুবনারী-টির সমস্যা কি ধরনের তার সমস্যার ধরণ বুঝে তার প্রতি বাড়িয়ে দিতে হবে সহানুভূতির হাত, যেন সে পরিবার ও সমাজের বোঝা না হয়ে নিজের পায়ে নিজেই দাঁড়াতে পারে, নিজের হাত দুটিকে কর্মীর হাতে রূপান্তর করতে পারে । আর এর জন্য আমাদের প্রয়োজন অটিজমে আক্রান্ত যুবদের জন্য তাদের উপযোগী প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল ও Multimedia content তৈরী -যাতে তারা সহজেই প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু গুলো হৃদয়ঙ্গঁম করতে পারে এবং প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজের কর্মসংস্থান নিজেই করে নিতে পারে । এবিষয়ে আজকের সেমিনারে আপনাদের মূল্যবান মতামত অটিজম অক্রান্ত যুবদের আত্মনির্ভরশীল ভবিষ্যৎ গড়তে মূল্যবান ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করি ।

কেন অটিজম হয় ?
কিছুদিন আগেও এ সম্পর্কে গবেষকদের সুস্পষ্ট ধারণা ছিলনা । কিন্তু গবেষনার ফলে বর্তমানে এই বিষয়ে কিছু উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমতঃ আমরা জানতে পারছি যে, কোন একক কারণে যেমন অটিজম হয়না তেমনি বিভিন্নধরনের অটিজম রয়েছে । গত ৫ বছরের গবেষনায়, বিজ্ঞানীরা কিছু সংখ্যক বিরল জিনগত (জীবকোষ) পরিবর্তন বা মিউটেশন লক্ষ্য করেছেন যার সংগে অটিজমের সম্পর্ক রয়েছে এবং তারা অটিজমের ঝুঁকি সৃষ্টিকারী ১০০ এর এর উপর জিন নির্ণয় করেছেন। শতকরা ১৫ ভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তি অটিজমের জন্য নির্দিষ্ট জেনেটিক (বংশগত বৈশিষ্ট্য) প্রভাবে এর যোগাযোগ রয়েছে । বস্তুত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মস্তিস্কের বিকাশকালীন সময়ে জটিল অটিজম সৃষ্টি হয়। অন্য কথায় বলা যায় , অটিজম প্রবন বংশগত কারণ, কতিপয় বংশগতি নিরপেক্ষ এবং পরিবেশগত প্রভাব- শিশুর মাঝে অটিজম হবার ঝুঁকি সৃষ্টি করে। শিশুর জন্ম পূর্ববর্তী এবং জন্মকালীন কোন বিশেষ ঘটনা পরিবেশগত ঝুঁকির অর্ন্তভূক্ত যেমন: গর্ভধারণের সময় পিতা-মাতার অধিক বয়স, গর্ভকালীন সময়ে মায়ের কোন অসুস্থতা, জন্মলাভের স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগেই শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়া অথবা জন্মকালীন সময়ে অস্বাভাবিক কম ওজন, জন্মকালীন জটিলতা- যেমন জন্মের সময়ে শিশুর মস্তিষ্কে কম অক্সিজেন সঞ্চালিত হওয়া প্রভৃতি। মায়েদের গর্ভকালীন সময়ে বায়ুদূষণ অথবা কীটনাশকের পরোক্ষ সংস্পর্শে আশাও শিশুর অটিজম হওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি সৃষ্টি করে । এটা মনে রাখা জরুরি যে এইসব এককভাবে অটিজম সৃষ্টি করেনা বরং বংশগত উপাদান সমূহের সংগে একত্রে মিশ্রিত হয়ে অধিক ঝুঁকি সৃষ্টি করে । একটি ছোট পরিসরের কিন্তু ক্রম বিকাশমান গবেষনায় দেখা গেছে যেসব শিশূদের মায়েরা তাদের গর্ভধারণের পূর্বের এবং পরবর্তী মাসগুলোতে ভিটামিন (যাতে ফলিক অ্যাসিড রয়েছে) সেবন করেছেন সেইসব শিশুদের অটিজম আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম। ক্রমবর্ধমানভাবে গবেষকরা অটিজমের উপর রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার ভূমিকা নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছেন ।

অন দা স্পেকট্রাম (পরিবারের মধ্যে) বলতে কি বুঝায়?
প্রতিটি অটিজম থাকা ব্যক্তির মধ্যে পৃথক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তবে এএসডি আছে এমন ব্যক্তিদের কারো কারো দেখে মনে রাখা, গান, শিল্পকলা ছবি আঁকা এবং গনিত বিষয়ে অত্যন্ত/চরম প্রখরতা থাকে। এদের মধ্যে শতকরা ৪০ শতাংশের বুদ্ধিমত্তা (আইকিউ এর মাত্রা ৭০ এর নীচে) থাকে অনেকের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক আবার কেউ কেউ অতি মেধাবী হয় । অটিজম স্পেকট্রামের অন্তর্ভূক্ত অনেক ব্যক্তি তাদের অসাধারণ বৈশিষ্টের জন্য গর্ব অনুভব করে কিন্তু বাকিরা অতি মাত্রার অক্ষমতার জন্য পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকে । প্রায় ২৫ শতাংশ অটিজম আছে এমন ব্যক্তিরা কথা বলতে পারেনা কিন্তু অন্যান্য উপায়ে তারা ভাব বিনিময় কৌশল শিখতে পারে ।

আমি কভাবে বুঝবো আমার সন্তানের অটিজম আছে কিনা ?
যদিও শিশুর বয়স ১৮ থেকে ২৪ মাস না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে অটিজম নির্ণয় করা যায় না, তবুও গবেষনায় ৮-১২ মাস বয়সের শিশুর মধ্যে অনেক সময় অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায়। অভিভাবকদের লক্ষ্য রাখতে হবে ৯ মাস বয়সের শিশুটির অধোবুলি (ব্যবলিং), হাসি বা নানারকম মুখোভঙ্গি করে কিনা? ১২ মাস বয়সের মধ্যে অধোবুলি (ব্যবলিং), হাত-পা দিয়ে শারীরিক কিছু ইঙ্গিত, ইশারা বা নির্দেশ (যেমন আঙ্গুল দিয়ে কিছু দেখান) করার প্রবনতা আছে কিনা অথবা যেকোন বয়সে অধোবুলি, কথাবলার বা ইঙ্গিত করার সামর্থ এবং স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে কিনা ।

আমার শিশুটির কোন সমস্যা হয়েছে এমন সন্দেহ হলে আমি কি করবো?
বিলম্ব না করেই তখনই একজন চিকিৎসক বা অটিজম বিষয়ক প্রাক প্রাথমিক সেবাদানকারী সংস্থার কারো কাছে শিশূটিকে নিয়ে যান। যাতে শিশুটির সমস্যা চিহ্নিত করা যায়। গবেষনায় দেখা গেছে প্রাথমিক অবস্থার অটিজম নির্ণয় করতে ও ব্যবস্থা নিতে পারলে অটিজমের ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়াগুলো অনেক সফলভাবে মোকাবেলা করা যায় ।

আমার শিশূর জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা কিভাবে পাবো?
প্রাথমিকভাবে অটিজম নির্ণয়ের পাশাপাশি একজন উপযুক্ত এই বিষয়ে জ্ঞান সম্পন্ন চিকিৎসক ও সেবাদানকারী দলের সহায়তা নেওয়া গুরুত্বপুর্ণ। অর্থাৎ অটিজম সম্পর্কে জানেন, বোঝেন এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক, থেরাপিস্ট, মনোবিজ্ঞানী, মানসিক রোগ চিকিৎসকএবং শিক্ষক খুঁজে বের করুন যাতে তারা শিশুর পরিবর্তনশীল চাহিদাগুলো সুঠকভাবে পুরণ করতে সক্ষম হবেন ।

আমার অটিজম আছে এমন সন্দেহ আছে এমন সন্দেহ দেখা দিলে কি করবো?
এ্যাসপারজার সিন্ড্রোম অথবা অন্য কোন উচ্চ ক্রিয়াশীল এএসডি (অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার) আছে এমন অনেকেরই তাদের শৈশবে অটিজম আছে তা সঠিক ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়না। কেউ কেউ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ হিসাবে পেশাগত বা সামাজিক সম্পর্ক জনিত সমস্যায় পড়লে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন । এজন্যই একজন অটিজম বিষয়ে বিশেষজ্ঞের সন্ধান জরুরি। চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত যে সব ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্কদের অটিজম নির্ণয়ের যোগ্যতা রাখেন তারা হলেন লাইসেন্সধারী ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞানী, বা নিউরোলজিন্ট এবং মনোরোগ চিকিৎসক। কিছু পেশাজীবি নার্স, সমাজকর্মী এবং মাস্টার্স পর্যায়ের মনোবিজ্ঞানীদেরও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অটিজম নির্ণয়ের যোগ্যতা আছে ।

আমি অটিজম রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়া কীভাবে মোকাবেলা করবো?
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অটিজম নির্ণিত হওয়া তাদের সারা জীবনের বিড়ম্বনার একটি যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা স্বস্তি বয়ে আনতে পারে । অভিভাবকগণ যখন প্রথম আবিস্কার করেন তাদের সন্তানের মাঝে স্বাভাবিক বিকাশগত অসুবিধা রয়েছে তখন থেকে পরবর্তী কয়েক মাস তাদের মধ্যে ভাবাবেগ ও বিভ্রান্তি বিরাজ করতে পারে এবং পরিস্থিতিকে বিরুপ মনে হতে পারে। তবে সন্তানের এরুপ অবস্থার জন্য অভিভাবকদের নিজেদের দায়ী করা উচিত নয় । এর পরের ধাপ হলো অটিজম সম্পর্কে নিজেদের প্রশিক্ষিত করে তোলা। এবিষয়ে জানাটাই আপনার শক্তি এবং আপনি অটিজম সম্পর্কে যত জানবেন ততই সঠিক ভাবে আপনার সসন্তানকে সহযোগিতা করতে পারবেন । সেই সাথে অভিভাবকদের ও কিছুটা বিশ্রাম নেওয়া ও বিরতি জরুরি, কেননা অটিজম থাকা শিশুদের সাথে কাজের জটিলতায় তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আপনি যদি অনুভব করেন সন্তানের এই অটিজম থাকার বিষয়টি আপনাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে তাহলে আপনি একজন কাউন্সিলর বা থেরাপিস্ট এর সাহায্য নিতে পারেন। আপনি এককভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করতে পারবেন এমনটা আশা করা যায়না ।

গ্রন্থনা

ইবনু সাব্বির আহমেদ

উপজেলা যুব উন্নযন কর্মকর্তা

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর

বদলগাছী, নওগাঁ ।

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *