ধর্ষণ বন্ধ করো; ধর্ষণ বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন..।

ধর্ষণ! গা শিউরে উঠা একটা শব্দ। ধর্ষণ একটি মারাত্বক সামাজিক ব্যাধি। সামাজিকতায় শৃঙ্খলে আবদ্ধ জনসমাজে এটি অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। চলমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্ষণ সংক্রান্ত পাপাচারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নারীরা জন্ম থেকেই অবহেলিত, যার প্রক্রিয়া পরিবার শৈশব থেকেই আরম্ভ করে। ফলে মেয়ে সন্তান অবহেলিত নারী এবং ছেলে সন্তান পরিনত হয় পুরুষ। যে যুগে সাম্যতার দন্ডে পরিমাপ যোগ্যতা নারী উভয়েরই আছে সে যুগেও নারী নিরাপত্তাহীনতায় লাঞ্ছিত হচ্ছে বারংবার।

 

যে নারী ধর্ষিত হচ্ছে তার ধষর্ণেও পাশাপাশি সমাজের লালায়িত মানুষেরা ধর্ষিতার সাথে তাঁর পরিবারকেও প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত করে। সামাজিক বয়কটের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয় ধর্ষিতার পরিবারও। “পাপকে ঘৃণা করো পাপীকে নয়।” লোকমুখে এর বহুল প্রচলন থাকলেও বাস্তবে এর বিপরীতই ঘটে। ১২ জুলাই ২১০৪ প্রথম আলোতে মানবাধিকার সংস্থা ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০১৩ সালে সারা দেশে মোট ৮১২জন নারী ধর্ষণ/গণধষর্ণের শিকার এবং চলতি বছরে জানুয়ারি হতে জুন পর্যন্ত ৩০৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সারা দেশে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

 

বাস্তবে যার পরিমাণ অনেক বেশি ধারণা করা যায় সামাজিক সন্মানের ভয়ে ধর্ষণের আইনি ব্যবস্থা নিতে ভয় পায় নির্যাতিতা। এক্ষেত্রে অনেক সময় গ্রামীণ সমাজে ধর্ষিতা বিচারের জন্য থানায় যেতে চাইলে। স্থানীয় মাতবর দ্বারা প্রভাবিত বিচার মেনে নিতে হয়, না হলে একঘরে হওয়ার ভয় থাকে। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় মাতবরদের দ্বারা হাস্যকর এবং ধর্ষক কর্র্তৃক প্রভাবিত বিচার প্রদৃত হয় যাতে ধর্ষকের উৎসাহ বৃদ্ধি করা হয় বৈকি। বাড়ে ধর্ষিতা সহ পরিবারের নিরাপত্তাহীনতা। বিচার চাওয়ার কারণে খুন হতে হয় অকালে ধর্ষকের হাতে ধর্ষিতার, অথবা বিচার না পাওয়ার কষ্টে আত্বহত্যার পথ বেঁছে নেয় ধর্ষিতা নারী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) – এর ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের

অপরাধের যে সকল শাস্তির বিধান রয়েছে তা হলো:-
১)ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং ইহার অতিরিক্ত অনুন্য এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডের বিধান। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে তবে উক্ত দলের সকলের জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
২)ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ দশ বছর এবং সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেরও বিধান ।
৩)কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন।
৪)পুলিশ হেফাজতে কোনো নারী বা শিশু ধর্ষিত হলে যাদের হেফাজতে থাকাকালে এ ধর্ষণ সংগঠিত হয়েছে তারা সকলেই নারী ও শিশুর হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য সর্বোচ্চ দশ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে দশ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
জেলা জজের আওতায় প্রতিটি জেলায় আইন সহায়তা কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে আবেদন করলে আর্থিক অথবা আইনজীবীর সহায়তা পেতে পারেন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কাছে আবেদন করে আইনি সহায়তা নিতে পারেন। থানা ও হাসপাতালে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে আইনগত সহায়তা ও চিকিৎসা পেতে পারেন। শাস্তির বিধান রয়েছে কিন্তু সে পর্যন্ত যেতে পারে না নির্যাতনের শিকার ধর্ষিতা নারী ও পরিবার। বর্বরতার শিকার ধর্ষিতা পরিবার বর্বর ছক ছিঁড়ে বেড়িয়ে থানায় মামলা দায়ের করতে পারলেও আসামী গ্রেপ্তারের পরে জামিন পেতে বেশি দেরি হয় না। আসামীর শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। ধর্ষণের পরে নিম্নোক্ত প্রমাণ বা সাক্ষ্য সংরক্ষণ করতে হবে:-
১) ধর্ষণের ঘটনাটি দ্রুত কাছের কাউকে জানাতে হবে কারণ তিনি আপনাকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করবেন এবং মামলার সময় সাক্ষ্য দিবেন।
২)ধর্ষণ প্রমাণের জন্য অতিব গুরুত্বপূর্ণ ধর্ষণের শিকার নারীর শরীর, এরজন্য ধর্ষণের ঘটনার পর যে অবস্থায় আছেন তেমনি রাখতে হবে, নিজেকে পরিষ্কার বা গোসল করা যাবে না। কারণ ধর্ষণের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর শরীরে কিছু প্রমাণ চিহ্ন থেকে যায়। ডাক্তারী পরীক্ষার দ্বারা নারীর শরীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণাদি এবং আলামত সংগ্রহ করা যায়, যা ধর্ষণ প্রমাণ ও ধর্ষণকারীকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
৩)ঘটনার সময় যে কাপড় গায়ে ছিলো অবশ্যই সংরক্ষণ করে কাগজের ব্যাগে করে এই কাপড় সংরক্ষণ করতে হবে কেননা কাপড়ে রক্ত, বীর্য ইত্যাদি লেগে থাকলে তা যদি ধর্ষণকারী সনাক্তকরণ এবং মামলার এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসাবে কাজ করে ।

 

***আলামত সংগ্রহের পর দ্রুত থানায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার নিকটবর্তী থানায় এজাহার বা অভিযোগ দায়ের করতে হবে। অভিযোগ দায়ের করার সময় ঘটনার সময়ের আপনার পরিধেয় কাপড় ও অন্যান্য সাক্ষ্য সাথে রাখতে হবে পুলিশ অফিসারের তদন্তের সুবিধার্থে। থানায় অভিযোগ দায়েরের পর যদি পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহন না করলে দ্রুত পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ-কে লিখিত ভাবে অবহিত করতে হবে। তাতেও পদক্ষেপ গ্রহন না করলে পরের দিন অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে মামলা দায়ের করতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ নারী সহ, তার পক্ষ থেকে যে কেউই (যিনি অপরাধ সম্পর্কে জানেন) এ অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। ধর্ষণের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডাক্তারী পরীক্ষা না করলে ধর্ষণের প্রমান পাওয়া যায় না। তাই এজাহার বা মামলা দায়েরের কাজ দ্রুত শেষ করা আবশ্যক।

 

পরীক্ষা শেষে ডাক্তার কর্র্তৃক পরীক্ষা সংক্রান্ত সার্টিফিকেট দেবেন। ডাক্তারী রিপোর্ট হাতে পেলে পুলিশ দ্রুততার সাথে ঘটনার তদন্ত শুরু করতে পারবেন। এজন্য ডাক্তারকে সবকিছু অবগত করতে হবে। ধর্ষণের প্রায় বেশিরভাগ ঘটনায় পূর্ববর্তী ঘটনার রেশ ধরে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সামান্য সচেতনতা ও সংঘবব্ধতায় ধর্ষণের জট খোলা এবং এর প্রতিরোধ সম্ভব। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সেবা নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তে জন্য নয় এমন ধারণা সবার মনে বদ্ধ পরিকর। নিরাপত্তাহীনতা দূর করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আশায় বসে না থেকে ধর্ষণ যাতে সংগঠিত না হয় তার জন্য সবাইকে সংগঠিত হতে হবে। সবাই একজোট/সংগঠিত না হলে ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। ধর্ষিতার পরিবারকে ধর্ষণের পরে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করাও কেউ থাকে না।

 

সবাই এটাকে ধর্ষিতার এবং তাঁর পরিবারের বলে দুরে থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু ধর্ষণ পরবর্তীতে ধর্ষিতার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোটা কি সামাজিক দায়বদ্ধতার নয়? প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্ষণের নামান্তরে নিত্যকার খুন। ধর্ষনের সাথে সম্পর্কিত আলোচিত চলমান একটা ঘটনা আত্বহত্যা। বর্তমানের ধর্ষনের এক নতুন পন্থার বহুল প্রচলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে প্রেমের সম্পর্কে জরিয়ে মেয়েদের সাথে দৈহিক চাহিদা মেটানোর পরে সম্পর্ক ছিন্ন করলে আত্বহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে মা-বাবার আদরের সন্তানেরা। এমন ঘটনার সাথে পরিচিত নন বা জানেন না এমন মানুষ সমাজে খুব কমই পাওয়া যাবে।

 

ধর্ষণের ফলে ঘটা মানসিক অসাড়তা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার বিপরীতে ঘৃণায় আত্বহত্যায় নিজের অস্তিত্ব বিলীন করতে বাধ্য হতে হয় নারীকে। ধর্ষকের কোনো বিশেষ শ্রেণী, পেশা বা বয়সে সীমাবদ্ধ নেই। ধর্ষণকারীকে সহজে চেনা যায় না। ধর্ষণকারী অচেনা হতে পারে আবার চেনা-জানা পরিচিতও হতে পারে। ধর্ষণের শিকার সব বয়সের নারীর জীবনেই আসতে পারে। অনেকের ধারণা ধর্ষণ অশালীন পোষাক, আচরণ এসবের কারণে হয় কিন্তু বাস্তবে সব ধরনের পোশাকেই নারীরাসহ শিশুও ধর্ষিত হচ্ছে। ধর্ষিতাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।

 

খারাপ মেয়েলোক হিসেবে সমাজে মিথ্যা আরোপ করা হয় নারীকে। অথচ সমাজের মানুষের উচিত ধর্ষিতার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে পাশে দাড়ানো। সতর্কতার মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করা। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।এক্ষেত্রে ধর্ষণ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য জনসাধারনকে জানিয়ে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে ।এবং ধর্ষণকারীর শাস্তির প্রচার করতে হবে, যেন সমাজ ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়। ধর্ষণ নারীর নির্যাতনের ব্যাধিগ্রস্ত কঠিন বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই একজোট না হওয়া পর্যন্ত। আইন যথাযোগ্য না হলে অপরাধীরা প্রশ্রয় পায়। প্রয়োজন যথাযথ আইনের কঠোর প্রয়োগ যাতে কেউ প্রশ্রয় না পায়। বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা বর্তমান প্রজন্মের দাবি। আসুন সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখি।

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *